বিশ্ব রাজনীতির মঞ্চে খুব কম ক্ষেত্রেই দেখা যায় কোনও দেশ প্রধান সরাসরি আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেন, বিশেষ করে যখন সেই আমন্ত্রণ আসে মার্কিন প্রেসিডেন্টের তরফ থেকে। কিন্তু ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির (PM Modi) পক্ষ থেকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমন্ত্রণ ‘সৌজন্যপূর্ণভাবে’ ফিরিয়ে দেওয়া ছিল নিছকই কোনও কূটনৈতিক ব্যস্ততা নয়, বরং এক কৌশলী বার্তা। এই পদক্ষেপ শুধু দু’দেশের মধ্যে বাড়তে থাকা বিশ্বাসের ঘাটতিকে সামনে এনেছে না, একইসঙ্গে দেখিয়েছে বিশ্ব কূটনীতিতে ভারতের পাল্টে যাওয়া অগ্রাধিকার।
এই ঘটনাক্রমে আরও তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়, যখন ভারত ও কানাডা এক দীর্ঘ দু’বছরের কূটনৈতিক শীতলতার পর একসঙ্গে বরফ গলানোর পথে এগিয়ে যায়। প্রধানমন্ত্রী মোদি (PM Modi) যখন কানাডায় অনুষ্ঠিত জি-৭ সম্মেলনে অংশ নিতে যান, তখন কানাডার নতুন প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নির পক্ষ থেকে তাঁকে দেওয়া উষ্ণ অভ্যর্থনা ছিল বহু অর্থবহ। কানাডা সরকার স্পষ্ট জানিয়েছে—মোদি-সদৃশ (PM Modi) একজন বিশ্বনেতাকে স্বাগত জানানো তাঁদের জন্য “গর্বের বিষয়”।
এটাই প্রমাণ করে, জাস্টিন ট্রুডোর শাসনামলের তিক্ত সম্পর্ক এখন অতীত, এবং বর্তমান সরকার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের নতুন অধ্যায় শুরু করতে আগ্রহী। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ট্রুডোর সময়ে ভারতকে (PM Modi) নিয়ে নানা বিতর্ক ও অভিযোগ সামনে এলেও, কার্নি ক্ষমতা নেওয়ার পর থেকেই তিনি স্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন—প্রো-খালিস্তানি লবির সঙ্গে তাঁর দূরত্ব থাকবে। সেই প্রেক্ষিতেই মোদিকে (PM Modi) আমন্ত্রণ জানানো এবং তাঁদের মধ্যে সফল দ্বিপাক্ষিক বৈঠক অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
এই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে—দুই দেশ আবার একে অপরের রাজধানীতে হাইকমিশনার পাঠাবে এবং বাণিজ্য আলোচনাও পুনরায় শুরু হবে। ২০২৪ সাল থেকে দুই দেশের মধ্যে এই যোগাযোগ স্তব্ধ ছিল। আগে কানাডার তরফ থেকে হরদীপ সিং নিজ্জরের হত্যাকাণ্ডে ভারতের বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযোগ তোলা হয়েছিল, যা সম্পর্ক তলানিতে ঠেলে দেয়। সেই ঘটনার প্রসঙ্গ এ বার পুরোপুরি এড়িয়ে গেছেন কার্নি। প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন—“বিচারিক প্রক্রিয়া চলছে, মন্তব্য করা সঠিক হবে না।”
এই পাল্টে যাওয়া অবস্থানের পাশাপাশি কানাডার গোয়েন্দা সংস্থা এবার সরাসরি স্বীকার করেছে যে, খালিস্তানি জঙ্গিরা কানাডার (PM Modi) মাটি ব্যবহার করছে ভারতের বিরুদ্ধে সহিংস কার্যকলাপ ছড়াতে। এই স্বীকৃতিও ভারতের কূটনৈতিক অবস্থানকে শক্তিশালী করে।
এই নতুন সম্পর্ক ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, কারণ ভারতই কানাডার শীর্ষ বিদেশি কর্মী ও আন্তর্জাতিক ছাত্র সরবরাহকারী দেশ এবং বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার।
অন্যদিকে, এই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক কিছুটা টালমাটাল। এমনকি, ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমন্ত্রণ ফিরিয়ে দেওয়ার পিছনে একাধিক কারণ রয়েছে। ট্রাম্প ফের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর অনেকেই ভেবেছিলেন, মোদি-ট্রাম্প (PM Modi) আগের মতোই ঘনিষ্ঠ থাকবেন। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, নানা ইস্যুতে মতবিরোধ তৈরি হয়েছে।
ট্রাম্প ভারতকে “ট্যারিফের বড় অপব্যবহারকারী” বলেই কটাক্ষ করেছেন একাধিকবার। এমনকি, মোদির সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে তিনি ভারতের পণ্যের উপর ২৬% আমদানি শুল্ক ঘোষণা করেছিলেন। যদিও সেটি আপাতত স্থগিত রয়েছে, তবে চুক্তির জন্য আমেরিকার চাপ রয়ে গিয়েছে।
সবচেয়ে বেদনাদায়ক হয়েছে ভারত-পাকিস্তান প্রসঙ্গে ট্রাম্পের ভূমিকা। মে মাসে পাহালগামে সন্ত্রাসী হামলার পর, জাতিসংঘে পাকিস্তান বা দায়ী সংগঠনের নাম স্পষ্টভাবে উল্লেখ করাতে ভারত ব্যর্থ হয়। তার উপর ট্রাম্প একাধিকবার দাবি করেছেন যে, তিনিই ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ থামাতে মধ্যস্থতা করেছিলেন—যা ভারত বারবার অস্বীকার করেছে।
সর্বশেষে, যখন ট্রাম্প মোদিকে আমন্ত্রণ জানান, তিনি সেই দিনই পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আসিম মুনিরের সঙ্গেও হোয়াইট হাউসে বৈঠকের সময় নির্ধারণ করেন। মোদি সেই বৈঠক এড়িয়ে যান, যাতে আবারও ভারত ও পাকিস্তানকে এক কূটনৈতিক সমতলে দেখানোর সুযোগ না তৈরি হয়। এই আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান ছিল একেবারে পরিকল্পিত ও কৌশলগত।

ভারত সরকার অবশ্য জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি ছিল এবং তিনি তখন ক্রোয়েশিয়া সফরে ছিলেন।
ট্রাম্প-মুনির বৈঠক মার্কিন প্রশাসনের মধ্যেও বিতর্ক তৈরি করেছে। প্রাক্তন পেন্টাগন আধিকারিক মাইকেল রুবিন এই বৈঠককে “ভুল ও বিপজ্জনক কৌশল” বলে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেছেন, পাকিস্তান একটি দ্বিমুখী রাষ্ট্র এবং তাদের বিশ্বাস করা ঝুঁকিপূর্ণ।
এই পরিস্থিতিতে, কানাডার সঙ্গে গলতে থাকা বরফ এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাড়তে থাকা সন্দেহের দেওয়াল ভারতের ভবিষ্যৎ কূটনীতিতে অনেকটা পথ দেখাবে।