বিশ্বজুড়ে বড় বড় আইটি কোম্পানিগুলি এখন এক অদ্ভুত সমীকরণের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। একদিকে তারা কর্মী ছাঁটাই করছে হাজার হাজার, অন্যদিকে সেই ছাঁটাইয়েই খরচ করছে কোটি কোটি ডলার ( Tech Layoffs)। একে কেউ বলছেন “সবচেয়ে ব্যয়বহুল খরচ কমানো”, কেউ আবার বলছেন “AI যুগের কৌশলগত পুনর্গঠন”।
গুগল, মেটা, অ্যামাজন, মাইক্রোসফট, অ্যাকসেঞ্চার থেকে টাটা কনসালট্যান্সি সার্ভিসেস (TCS)—সবাই ছাঁটাইয়ের ঢেউয়ে শামিল ( Tech Layoffs)। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে, এই ছাঁটাইয়ের বিলই এখন ইতিহাসের অন্যতম বড় কর্পোরেট খরচে পরিণত হয়েছে।
মানবসম্পদ বিশেষজ্ঞ শ্রুতি স্বরূপ, Embrace Consulting-এর প্রতিষ্ঠাতা, ব্যাখ্যা করেছেন কেন এই বিশাল ব্যয়ের মধ্যেও কোম্পানিগুলি খুশি মনে ছাঁটাই করছে ( Tech Layoffs)। তাঁর কথায়, “ছাঁটাই প্যাকেজ বা সেভারেন্স মূলত এককালীন ব্যয়, কিন্তু সেটা ভবিষ্যতের আইনি ঝুঁকি, ব্র্যান্ড ক্ষতি ও অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা রোধ করে। সংস্থার ভাবমূর্তি রক্ষায় এটি বিনিয়োগের মতোই গুরুত্বপূর্ণ।”
অর্থাৎ, এখনই কিছু টাকা খরচ করে ভবিষ্যতে আরও বড় আর্থিক চাপ এড়াতে চাইছে কোম্পানিগুলি ( Tech Layoffs)। শ্রুতি বলেন, “এই ব্যয় সহানুভূতি থেকে নয়, এটা সম্পূর্ণ রিস্ক ম্যানেজমেন্ট। টেক দুনিয়ায় যেখানে ব্র্যান্ড ইমেজ আর প্রতিভা ধরে রাখা সবচেয়ে বড় সম্পদ, সেখানে বড়সড় ছাঁটাইও ‘ইমেজ কনট্রোল’-এর অংশ।”
টিসিএস সম্প্রতি ঘোষণা করেছে প্রায় ২০,০০০ কর্মী ছাঁটাইয়ের সিদ্ধান্ত, AI-নির্ভর পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে। এককালীন প্রায় ₹১,১৩৫ কোটি টাকা ব্যয় হবে এই প্রক্রিয়ায়—যার মধ্যে রয়েছে তিন মাসের নোটিশ পে, ছয় মাস থেকে দুই বছরের বেতন পর্যন্ত সেভারেন্স, আগাম অবসর এবং মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তাও ( Tech Layoffs)।
একইভাবে অ্যাকসেঞ্চার গত তিন বছরে ছাঁটাই বাবদ খরচ করেছে ২ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। সম্প্রতি আরও ৬১৫ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করা হয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) ও অটোমেশন-নির্ভর নতুন ডেলিভারি মডেলে যেতে। সংস্থার সিইও জুলি সুইট স্পষ্ট জানিয়েছেন, “যে কাজগুলি পুনরায় প্রশিক্ষণ দিয়ে চালানো সম্ভব নয়, সেগুলিকেই বাদ দেওয়া হচ্ছে।”
শ্রুতি স্বরূপ বলেন, “একটি কোম্পানি যখন ছাঁটাই ঘোষণা করে, তখনই সেই ত্রৈমাসিকে এই ব্যয় হিসাবভুক্ত হয়। এতে সাময়িকভাবে আয় ও নগদ প্রবাহ কমে যায়, কিন্তু পরবর্তী ত্রৈমাসিক থেকে লাভজনক কাঠামো গড়ে ওঠে।”
বিশেষজ্ঞদের মতে, কোম্পানিগুলির উদ্দেশ্য স্পষ্ট—এখন এককালীন ক্ষতি মেনে নিয়ে ভবিষ্যতের জন্য আর্থিক কাঠামোকে হালকা ও লাভজনক করে তোলা।
অন্যদিকে গ্রেট লেকস ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্টের অধ্যাপক ড. বিভাভ সিংহ জানিয়েছেন, “AI যুগে ছাঁটাই মানে শুধু খরচ কমানো নয়, এটা এক ধরনের সাংগঠনিক পুনর্গঠন। যেসব কাজ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা করতে পারে, সেই জায়গা থেকে মানুষকে সরিয়ে মূলধন অন্যত্র বিনিয়োগ করা হচ্ছে। তাই সেভারেন্স প্যাকেজ হচ্ছে কোম্পানির ট্রানজিশন কস্ট।”
তিনি আরও বলেন, “এমন ছাঁটাই বাজারে আতঙ্ক না ছড়িয়ে বিনিয়োগকারীদের আস্থা বজায় রাখতেও সাহায্য করে। আসলে ছাঁটাইয়ের সংখ্যা নয়, ছাঁটাইয়ের ধরনটাই বদলে গিয়েছে।”
গুগল, মেটা, অ্যামাজন, মাইক্রোসফট, সেলসফোর্স—সবাই এখন এই পথে হাঁটছে। গুগল ২০২৫ সালের শুরুতে ১২,০০০ কর্মী ছাঁটাইয়ের সময় রেখেছিল ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি সেভারেন্স বাজেট। মেটা একই সময় ব্যয় করেছে প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার, AI ও মেটাভার্সে বিনিয়োগ বাড়ানোর লক্ষ্যে। অ্যামাজনও তাদের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ছাঁটাই—৩০,০০০ কর্পোরেট কর্মী কমানোর পরিকল্পনায়—শত কোটি ডলারের খরচ বহন করছে।
ড. সিংহ বলেন, “বর্তমান কর্মীরা যখন দেখেন সংস্থা প্রাক্তন কর্মীদের প্রতি ন্যায্য আচরণ করছে, তখন তাদের মনে বিশ্বাস জন্মায় যে সংস্থাও তাদের পাশে থাকবে। এটি কোম্পানির অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা বাড়ায়।”
তাঁর মতে, আইটি দুনিয়ায় রেপুটেশন বা ভাবমূর্তি সবচেয়ে বড় পুঁজি। “একটি কোম্পানি কীভাবে তার কর্মীদের বিদায় দেয়, সেটাই বলে দেয় তার সংস্কৃতি কেমন। তাই বড় সংস্থাগুলি এখন আইনি বাধ্যবাধকতার বাইরেও মানবিক দিক থেকে উদার প্যাকেজ দিচ্ছে। এর উদ্দেশ্য—‘অমানবিক’ ট্যাগ থেকে দূরে থাকা এবং প্রতিভাবান কর্মীদের কাছে আকর্ষণীয় থাকা।”
সবশেষে দুই বিশেষজ্ঞই একমত—এই বিলিয়ন ডলারের সেভারেন্স বিল সহানুভূতির প্রকাশ নয়, বরং সুপরিকল্পিত বিনিয়োগ। ড. সিংহের কথায়, “এটি এক ধরনের কৌশলগত খরচ। আজ সামান্য ক্ষতি মেনে নিয়ে সংস্থাগুলি ভবিষ্যতের খরচ অনেকটাই কমিয়ে আনছে। বরং খারাপ রেপুটেশন বা প্রতিভা হারানোর খরচ এই সেভারেন্স বিলের চেয়ে অনেক বেশি।”
শেষ কথা একটাই—AI যুগে ছাঁটাইও এখন ব্যবসায়িক কৌশলের অংশ। কোম্পানিগুলি বুঝে গিয়েছে, মানুষকে বিদায় জানাতে হলেও, সেটি এমনভাবে করতে হবে যাতে ভবিষ্যতে তার দাম না দিতে হয়। অর্থাৎ, আজ মানুষকে টাকা দিয়ে বিদায় জানানোই আগামী দিনের সবচেয়ে সাশ্রয়ী বিনিয়োগ।







