সম্প্রতি পাকিস্তানের পারমাণবিক স্থাপনায় একটি সম্ভাব্য রেডিয়েশন বা পারমাণবিক দুর্ঘটনার ( Radiation Leak) গুজব ঘিরে সোশ্যাল মিডিয়ায় তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। গুজব অনুযায়ী, পাকিস্তানের সারগোধা জেলার কিরানা হিলস অঞ্চলে এই পারমাণবিক স্থাপনাটি ( Radiation Leak)অবস্থিত। সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশ কিছু ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে (Radiation Leak), যার জেরে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে।
ইন্টারনেটে এমন কিছু ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে যেখানে কিরানা হিলসের আশেপাশের গ্রামের ফাঁকা বাড়িগুলো দেখানো হয়েছে। দাবি করা হচ্ছে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী এই অঞ্চলের গ্রামগুলো খালি করে দিচ্ছে কারণ পারমাণবিক স্থাপনাটি সাম্প্রতিক ভারত-পাকিস্তান সামরিক উত্তেজনার সময় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
একটি ভিডিওতে একজন ব্যক্তি দাবি করছেন, দুইটি মিসাইল কিরানা হিলসে আঘাত হেনেছে ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্বের সময়। আরেকটি ভিডিওতে, নাম না বলা একটি গ্রামের ফাঁকা বাড়িগুলো দেখিয়ে বলা হচ্ছে, সেনাবাহিনী সব মানুষকে সেখান থেকে বের করে দিয়েছে।
রেডিয়েশন চিহ্নিতকারী মার্কিন বিমান পাকিস্তানের আকাশে?
আরও সন্দেহ সৃষ্টি হয় যখন খবর ছড়ায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের “Beechcraft B350 AMS” নামক একটি বিশেষ বিমান পাকিস্তানের আকাশে দেখা গেছে। এই AMS (Aerial Measuring System) বিমানটি মূলত পারমাণবিক বা রেডিয়েশন দুর্ঘটনার সময় বাতাসে তেজস্ক্রিয়তা শনাক্ত করার জন্য ব্যবহৃত হয়।
পাকিস্তান সরকার এ নিয়ে কিছু বলেনি, তবে কিছু ফ্লাইট ট্র্যাকিং ওয়েবসাইট (যেমন Flightradar24) একটি N111SZ নাম্বারের B350 AMS বিমানের পাকিস্তানের আকাশে উপস্থিতির ইঙ্গিত দিয়েছে। কিছু ওপেন সোর্স গোয়েন্দা বিশ্লেষক বলছেন, এই বিমানটি ২০১০ সালে পাকিস্তান আর্মি অ্যাভিয়েশনের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছিল। যদিও তাই হয়ে থাকে, তবু এই বিমানের আসল উদ্দেশ্য পারমাণবিক শনাক্তকরণ হওয়ায় সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়েছে।
এছাড়াও, কিছু অসমর্থিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বোরন বহনকারী একটি মিশরীয় বিমান পাকিস্তানের মুরি শহরে এসেছে ও চলে গেছে। উল্লেখ্য, বোরন হচ্ছে এমন একটি পদার্থ, যা পারমাণবিক বিকিরণ দমনে ব্যবহৃত হয়।
উভয় দেশ গুজব অস্বীকার করলেও উদ্বেগ রয়ে গেছে
ভারত ও পাকিস্তান উভয়েই দাবি করেছে যে, কিরানা হিলসের পারমাণবিক স্থাপনায় কোনও হামলা হয়নি। ভারতের বিমান বাহিনীর ডিরেক্টর জেনারেল অফ এয়ার অপারেশনস, এয়ার মার্শাল এ. কে. ভরতি সাংবাদিক বৈঠকে বলেন,
“আপনারা যদি বলেন যে কিরানা হিলসে পাকিস্তান তাদের পারমাণবিক অস্ত্র রেখেছে, তাহলে ধন্যবাদ। কিন্তু আমরা কিরানা হিলসকে লক্ষ্য করিনি, সেটা যাই হোক না কেন।”
পাকিস্তানের সামরিক মুখপাত্র ডিরেক্টর জেনারেল আইএসপিআর, শরীফ আহমেদ চৌধুরীও ভারত কিরানা হিলসে হামলা করেছে এই দাবি অস্বীকার করেছেন।
তবুও, এই পরিস্থিতি দক্ষিণ এশিয়ায় একটি পারমাণবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা তৈরি করেছে।
মার্কিন প্রতিক্রিয়া: উত্তর এড়িয়ে গেলো স্টেট ডিপার্টমেন্ট
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্র টমি পিগট একটি সাংবাদিকের প্রশ্নে কিরানা হিলসে পারমাণবিক গোপনীয়তা নিয়ে কিছু বলতে অস্বীকার করেন। তিনি বলেন,“এই মুহূর্তে এ বিষয়ে বলার কিছু নেই।”
‘অপারেশন সিঁদুর’: ভারতীয় প্রতিশোধমূলক হামলা
২২ এপ্রিল জম্মু-কাশ্মীরের পাগলগাঁওয়ে ইসলামপন্থী জঙ্গিদের হামলায় ২৬ জনকে ধর্ম যাচাই করে হত্যা করা হয়। এই হামলার প্রতিক্রিয়ায় ভারত পাকিস্তান ও পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীর (PoK)-এ জঙ্গি ঘাঁটিগুলিতে একাধিক নিশানাভিত্তিক (precision) হামলা চালায়। এই সামরিক অভিযানের কোডনেম ছিল ‘অপারেশন সিঁদুর’।
পরে পাকিস্তান ভারতের পশ্চিম সীমান্তে ড্রোন হামলা শুরু করলে, ভারতও পাল্টা আক্রমণ চালায় পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ১১টি বিমানঘাঁটিতে। এই বিমানঘাঁটিগুলোর মধ্যে রয়েছে: নূর খান, রফিকি, মুরিদ, সুক্কুর, শিয়ালকোট, পাসরুর, চুনিয়ান, স্কারদু, ভোলারি, জ্যাকোবাবাদ ও সারগোধা।
এই সারগোধা অঞ্চলই কিরানা হিলসের আশেপাশে, যেখানে পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডার থাকার সম্ভাবনা রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। ভারতীয় ড্রোন ও মিসাইল হামলায় পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা অবকাঠামো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
কিরানা হিলস: পাকিস্তানের পারমাণবিক প্রকল্পের রহস্যঘেরা স্থান
কিরানা হিলস বা ব্ল্যাক মাউন্টেনস হচ্ছে প্রায় ৮০ কিমি দীর্ঘ একটি পাহাড়ি এলাকা, যেটি পাকিস্তানের সারগোধা জেলায় অবস্থিত এবং ভারতের সীমান্ত থেকে প্রায় ১৭০ কিমি দূরে। ব্রিটিশ আমলে এখানে বিভিন্ন গবেষণা পরিচালিত হত। ১৯৭০ সালের দিকে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এই এলাকাটি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয়।
বর্তমানে এটি পাকিস্তানের মুশাফ বিমানঘাঁটির অংশ, যেখানে F-16 ও JF-17 যুদ্ধবিমান রাখা হয়। অনেকে মনে করেন, এই এলাকাতেই পাকিস্তানের পারমাণবিক প্রকল্পের কিছু গোপন অংশ রয়েছে এবং আগে এখানে ইউরেনিয়ামের সন্ধানে খনন কাজও হয়েছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, পাকিস্তান ১৯৭৮-৭৯ সালের দিকে এখানে পারমাণবিক কার্যক্রম শুরু করে। ২০২৩ সালে Bulletin of the Atomic Scientists জানিয়েছে, কিরানা হিলস ১৯৮৩ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সাব-ক্রিটিক্যাল পারমাণবিক পরীক্ষার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। এখানে টেল (TEL – Transporter Erector Launcher) গ্যারেজ, গোলাবারুদের গুদাম ও অন্তত ১০টি ভূগর্ভস্থ সংরক্ষণাগার রয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
কিরানা হিলসকে ঘিরে পারমাণবিক দুর্ঘটনার গুজব নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। যদিও সরকারিভাবে কিছুই নিশ্চিত করা হয়নি, তবে ভিডিও, ফ্লাইট ডেটা ও মার্কিন বিমানের উপস্থিতির খবর গুজবকে উসকে দিয়েছে।