যাঁরা এক সময় পাকিস্তানের (Pakistan) প্রতিষ্ঠায় সরাসরি সমর্থন জানিয়েছিলেন, আজ তাঁরাই সেই রাষ্ট্রে নিগৃহীত—এটাই আজকের বাস্তবতা পাকিস্তানে আহমদিয়া মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য। হজরত খলিফাতুল মাসিহ প্রথমের নেতৃত্বে আহমদিয়া সম্প্রদায় মুসলিম লীগের ও মুহাম্মদ আলি জিন্নাহর প্রতি নিঃশর্ত সমর্থন জানিয়েছিলেন ধর্মীয় কারণে, পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির প্রতিষ্ঠায় তাঁরা বড় ভূমিকা পালন করেছিলেন (Pakistan)। কিন্তু আজ সেই পাকিস্তানেই, তাঁদের ধর্ম পালনের অধিকার প্রতিনিয়ত কেড়ে নেওয়া হচ্ছে।
আরও একবার সেই নিপীড়নের চরম বহিঃপ্রকাশ দেখা যাচ্ছে কোরবানি ঈদ (ঈদ-উল-আযহা) সামনে আসতেই (Pakistan)। জুন ৭, ২০২৫-এ ঈদ, কিন্তু এর আগেই পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের বিভিন্ন জায়গায় আহমদিয়াদের ওপর চাপ দেওয়া হচ্ছে—তাঁরা যেন কোরবানি না করেন, এমনকি নিজেদের বাড়ির মধ্যেও না। আরও চরম পদক্ষেপ হিসেবে, অনেককে শর্তযুক্ত হলফনামা (affidavit) দিতে বাধ্য করা হচ্ছে, যেখানে বলা হচ্ছে—যদি তাঁরা ঈদের কোনো ধর্মীয় কার্যকলাপ করেন, তাহলে ৫ লাখ পাকিস্তানি রুপি জরিমানা দিতে হবে (Pakistan)।
পাঞ্জাব ও সিন্ধু প্রদেশের বিভিন্ন জেলাতে পুলিশ সদস্যরা আহমদিয়া সম্প্রদায়ের মানুষদের হুমকি দিচ্ছেন, গ্রেপ্তার করছেন, এবং বাধ্য করছেন ঈদের ধর্মীয় কাজ না করার লিখিত মুচলেকা দিতে।
অথচ পাকিস্তানের সংবিধানে এমন কোনো আইন নেই, যেখানে বলা হয়েছে আহমদিয়ারা নিজেদের বাড়িতে পশু কোরবানি দিতে পারবেন না। কিন্তু তথাকথিত ‘আইনি নির্দেশনা’র নামে তাঁদের নাগরিক অধিকার খর্ব করা হচ্ছে। বিভিন্ন সূত্র অনুযায়ী, পাঞ্জাবে এ পর্যন্ত প্রায় ৩৬টি বেআইনি গ্রেপ্তার ও হয়রানির ঘটনা ঘটেছে শুধুমাত্র কোরবানি ঠেকানোর জন্য।
কারাচিভিত্তিক সংবাদপত্র ডন জানিয়েছে, বিভিন্ন জায়গায় আহমদিয়াদের হলফনামা ও ইন্ডেমনিটি বন্ড দিতে বাধ্য করা হচ্ছে, যেখানে লেখা থাকে—তাঁরা ঈদ উদযাপন করবেন না বা ইসলামি রীতিতে কোনো কাজ করবেন না (Pakistan)।
একটি হলফনামার ফর্ম, যা পাঞ্জাব সরকারের তরফে জারি হয়েছে এবং যা পাকিস্তানি-মূলের (Pakistan) মার্কিন সাংবাদিক সাবুখ সৈয়দ প্রকাশ করেছেন, সেখানে উল্লেখ করা আছে—শর্ত লঙ্ঘন করলে ৫ লাখ রুপি জরিমানা দিতে হবে। আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ধরণের হলফনামা আদায় করা অসাংবিধানিক এবং স্থানীয় প্রশাসনের এখতিয়ারের বাইরে।
এরপর আবার, লাহোর হাই কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন (LHCBA) একটি চিঠি পাঠিয়ে পাঞ্জাবের আইজি-কে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে। তারা দাবি করেছে, আহমদিয়ারা যদি কোরবানির মতো ইসলামি রীতি পালন করে, তাহলে তা সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয় এবং “সার্বজনীন বিশৃঙ্খলা” তৈরি হতে পারে।
এই মন্তব্যের পর পুরো দেশজুড়ে আরও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে। উল্লেখযোগ্যভাবে, আহমদিয়ারা কোরআন পড়তে, নামাজ পড়তে বা ঈদ পালন করতে পারেন না—এমনকি তাঁদের কবরস্থান পর্যন্ত বারবার ধ্বংস করা হচ্ছে। ২০২৪ সালের মার্চ মাসে, পাঞ্জাবের খুশাব জেলায় আহমদিয়াদের প্রায় ১০০টি কবরস্থানে হামলা চালিয়ে সব কবর ভেঙে ফেলা হয়। এই ঘটনা ঘটায় তেহরিক-ই-লাব্বাইক পাকিস্তান (TLP) নামের কট্টর সংগঠনের সদস্যরা।
পাকিস্তানে আনুমানিক ২০ লাখ আহমদিয়া বসবাস করেন। তাঁদের ১৯৭৪ সালের দ্বিতীয় সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে “অমুসলিম” ঘোষণা করা হয়, এবং ১৯৮৪ সালে জিয়া-উল-হক কর্তৃক প্রণীত অর্ডিন্যান্স XX-এর মাধ্যমে ইসলামি রীতিচর্চা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়। এই আইন অনুযায়ী, যদি কেউ নিজেকে মুসলমান দাবি করেন বা মুসলমানের মতো আচরণ করেন—তাহলে তাঁর তিন বছর পর্যন্ত জেল হতে পারে।
এই বৈষম্য শুধু ধর্মীয় পর্যায়ে সীমাবদ্ধ নয়—আহমদিয়াদের জন্য ভোটদানের প্রক্রিয়াও আলাদা করা হয়েছে, যার ফলে রাজনৈতিকভাবে তাঁদের অধিকার সম্পূর্ণভাবে নষ্ট হয়েছে।
তাঁরা যাঁরা পাকিস্তান গঠনে সহায়তা করেছিলেন, আজ তাঁদেরই ঈদ উদযাপন করতে দেওয়া হচ্ছে না। রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের এই চিত্র ঈদের আগে আরও নির্মমভাবে চোখে পড়ে—যেন বারবার তাঁদের মনে করিয়ে দেওয়া হচ্ছে, “তোমরা এখানে মানুষ নও, মুসলমান তো নওই।”